দাপুটে আইনজীবীরা লাপাত্তা
১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৩ এএম
মানুুষ বিপদে পড়লে কিংবা আইনি ঝামেলায় পড়ে আইনজীবীদের দ্বারস্থ হন। আইনজীবীরা মানুষের পক্ষে আইনি লড়াই করেন। তারা যেমন নিরপরাধ ব্যক্তিদের পক্ষে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হন। তেমনি দাগী অপরাধী, খুনি, ধর্ষক, চাঁদাবাজ, দখলবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, প্রতারক, জালিয়াতের পক্ষেও আইনি সেবা দেন। পেশাদার আইনজীবীদের চোখে ‘সবাই সমান’। বিচারপ্রার্থী যদি আইনের চোখে ‘অপরাধী’ ও হন আইনজীবীর চোখে তিনি ‘ক্লায়েন্ট’ কিংবা ‘মক্কেল’। অপরাধী অপরাধ করে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলে আইনজীবী তার জামিন করান। অপরাধ সংঘটনের পর আসামি ‘পলাতক’ কিংবা ‘আত্মগোপনে’ থাকলে তাকে আত্মসমর্পণপূর্বক জামিনের ব্যবস্থা করে দেন আইনজীবী। কিন্তু যে আইনজীবী আসামির পক্ষে-বিপক্ষে আইনি সহায়তা দেন সেই আইনজীবীদের অনেকের নাম উঠেছে ‘আসামি’র তালিকায়। বিশেষত আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আইনজীবীদের ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এর ফলে ক’দিন আগের সেই দাপুটে আইনজীবীদের এখন আর দেখা মিলছে না আদালতের বারান্দায়।
আইনজীবীরা আদালতে ‘অ্যাপিয়ার’ হতে না পারায় অনেক বিচারপ্রার্থী তাদের মামলা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তারা না পারছেন পূর্বতন আইনজীবীর সাক্ষাৎ না পাচ্ছেন তাদের কোনো নাগাল। মামলার মাঝপথে নিয়োগকৃত আইনজীবী লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় তাদের কাছ থেকে এনওসিও (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নিতে পারছেন না। ফলে নিযুক্ত আইনজীবী আদালতে উপস্থিত থাকার নতুন এক দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ছে মামলা। আগামী ২০ অক্টোবর খুলছে উচ্চ আদালত। তখন আরো বেশি বিপাকে পড়বেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের মক্কেলরা। প্রাক্টিসিং আইনজীবীরা জানান, সাধারণত বিচারে ‘ফেভার’ পাওয়া যাবে এমন আশায় সরকারঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদেরকে মামলায় ‘সিনিয়র আইনজীবী’ হিসেবে যুক্ত করেন বিচারপ্রার্থীরা। বিচারাঙ্গনে এই রেওয়াজ চলে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। সেই রেওয়াজই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বিচারপ্রার্থীদের জন্য। তারা নিযুক্ত মূল আইনজীবীর দেখা পাচ্ছেন না। ফলে সিনিয়রের চেম্বার সংশ্লিষ্ট ‘জুনিয়র’ আইনজীবী দিয়ে বারবার সময় নিতে হচ্ছে আদালতের কাছ থেকে। এতে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ছে। খরচ হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
একইভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সরকারি প্রতিষ্ঠানের মামলা পরিচালনায়ও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। তারিখের পর তারিখ পড়লেও মামলা পরিচালনায় হাজির হচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে উচ্চ আদালতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে দেড় যুগ ধরে মামলা পরিচালনা করে আসছেন অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান। বলা হয়, দুদকের ৮০ শতাংশ মামলাই পরিচালনা করেন এই আইনজীবী। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট থেকে নিরুদ্দেশ খুরশিদ আলম খান। অন্যদিকে ঢাকার অধোস্তন আদালতে দুদকের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতেন অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল। হাসিনা সরকার উৎখাতের পর থেকে তিনি লাপাত্তা।
পেশাদার আইনজীবী হিসেবে ঢাকা এবং সুপ্রিম কোর্ট বারে প্রাক্টিস করছেন অ্যাডভোকেট মো. রেজাউল করিম। বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আইনজীবী সমিতিগুলো পেশাদারদের কাছ থেকে রাজনীতিকদের হাতে চলে গেছে। যতটা না আইন চর্চা হয়, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে রাজনীতি চর্চা। বারে রাজনীতি চর্চাটাই হয় আদালতের কাছে আনডিউ কিছু প্রিভিলাইজ নেয়ার জন্য। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করে একশ্রেণির আইনজীবী নিজেদের ‘বড় আইনজীবী’ হিসেবে জাহির করেন। এতে বিভ্রান্ত হয়ে বিচারপ্রার্থীরা তাদের দ্বারস্থ হন। ফলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে যারা আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আদালতের কাছে অ্যাডভান্টেজ নিয়েছেন, তারা এখন রাজনৈতিক কারণে পলাতক। যার মাশুল দিচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। আগে-পরে বিবেচনা করে মামলায় আইনজীবী নিয়োগ দিতে হয়।
তা না করে বিচারে ‘ফেভার’ লাভের উদ্দেশ্যে আওয়ামী পদ-পদবিধারী আইনজীবীদেরকে মামলা পরিচালনায় যুক্ত করেন অনেকে। তারাই এখন ভোগান্তিতে পড়েছেন বেশি।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা জালিম শাহীর তখত তাউস উবে যাওয়ার পর চট করেই পাল্টে যায় বিচারাঙ্গনের দৃশ্যপট। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও সুপ্রিম কোর্টে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ হাসিনার আমলে নিযুক্ত আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি। তারা হাসিনার বিচার বিভাগীয় শাসনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। শেষ চেষ্টাটি করেন ১০ আগস্ট বিচার বিভাগীয় ক্যু করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু হাসিনার অপসারণ আন্দোলনে সদা জাগ্রত ছাত্র-জনতার তীব্র প্রতিবাদে রুখে দেন ‘জুডিশিয়াল ক্যু’। ওই দিন বিকেলেই পদত্যাগে বাধ্য হন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি। এর পরে ওই ছয় বিচারপতিকে আর জনসম্মুুখে দেখা যায়নি। একই সঙ্গে বিচারাঙ্গন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান আওয়ামী সমর্থক অনেক আইনজীবী। গত দেড় দশক ‘আওয়ামী লীগের আইনজীবী’ হিসেবে গাছের খেয়ে-তলারটাও কুড়িয়েছেন তাদের এখন দেখা মিলছে না।
এক সময়ের ডাকসাইটের আইনজীবীর অনেকেই এখন আত্মগোপনে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হত্যার ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে নিজেরাই এখন আসামির কাঠগড়ায়। গ্রেফতার হয়ে কেউ কারাগারে গেছেন। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে রাজনৈতিক নেতারা গ্রেফতার হতেন কিংবা আত্মগোপনে চলে যেতেন। এ সময় তাদের পক্ষে আইনি লড়াই পরিচালনা করার জন্য এগিয়ে আসতেন আইনজীবীরা। এবার ঘটলো উল্টো। খোদ আইনজীবীরাই এখন পলাতক। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে মামলা। এখনো মামলা হয়নি, এমন আইনজীবীরাও দিয়েছেন গা ঢাকা। যারা গ্রেফতার এড়াতে পেরেছেন তারা আছেন আত্মগোপনে। যা বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।
গা ঢাকা দিয়ে আছেন এমন আওয়ামী আইনজীবীর তালিকা দীর্ঘ। এর মধ্যে রয়েছেন, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহŸায়ক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, আ.লীগ সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, আ.লীগ সরকারের মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর, ব্যারিস্টার শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর (প্রশাসন) অ্যাডভোকেট মোখলেছুর রহমান বাদল, সৈয়দ হায়দার আলী, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির, ‘ডামি নির্বাচন’-এর এমপি ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক, অ্যাডভোকেট আবদুন নূর দুলাল, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম, দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ‘বান্ধবী’খ্যাত অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম, দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান, স্পেশাল পিপি আবু আব্দুল্লাহ, আ.লীগের আইন-বিষয়ক সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরুসহ অনেকে। ৫ আগস্টের আগেও আইনাঙ্গনে ছিল তাদের সদম্ভ বিচরণ। শেখ হাসিনার পক্ষে ¯েøাগান-মিছিল করেছেন। মামলা পরিচালনায় তাদের ফি যেমন বেশি ছিল তেমনি তাদের ‘চাহিদা’ও ছিল তুলনামূলক বেশি। তারাই এখন আত্মগোপনে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মগোপনে থেকেও ভার্চুয়ালি এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছেন। তাদের ভাষ্য, হাসিনাবিহীন বাংলাদেশ তারা নিজেরা খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। জনরোষ, হামলা, মামলা ও গ্রেফতারের ভয়ে তারা কৌশলগতভাবে আপাতত মামলা পরিচালনা থেকে বিরত রয়েছেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সেনবাগে মর্মান্তিক মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় ভাগ্নে নিহত : মামা আহত
কুষ্টিয়ায় সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় গৃহবধুকে নির্যাতন
রাজশাহীর বাগমারায় পুকুর থেকে ভ্যান চালকের লাশ উদ্ধার
কুষ্টিয়ায় ট্রাক ও নছিমন সংঘর্ষে গরু ব্যবসায়ী নিহত
র্যাবকে সমাজে রাখা ঠিক হবেনা -রাজশাহীতে নূর খান
নওগাঁয় ৩ জনকে পিটিয়ে জখম, আহতদের উদ্ধার করলো পুলিশ
মাদারীপুরে গুড়ি বৃষ্টি আর হিমেল বাতাসে জনজীবন স্থবির
দুমকীতে বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ দাফনে বাঁধা
দুবাই মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীর অ্যাওয়ার্ড লাভ
'বরবাদ' সিনেমা শতকোটির গন্ডি পেরিয়ে যাবে! কি বললেন শাকিব?
রাজশাহীর পুঠিয়ায় বাস চাপায় মা ছেলেসহ একই পরিবারের তিনজন নিহত
দোয়ারাবাজারে ভারতেীয় সীমান্তে ৩০০ বস্তা রশুন আটক করেছে টাস্কফোর্স
রাজশাহীতে নেসকোর ভৌতিক বিল বন্ধসহ নানারকম হয়রানীর প্রতিবাদে বিক্ষোভ
শ্যামনগর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার
যুবদলের উদ্যোগে ৩১ দফা অবহিতকরণে আলোচনা সভা
এমাজউদ্দীন আহমদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বজনীন
বাংলাদেশে সা'দ পন্থিদের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে: হাটহাজারীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে বক্তারা
ভারত বাধা পেরিয়ে শিরোপা জিততে মরিয়া বাংলাদেশ
দোয়ারাবাজারে ভ্যানের ধাক্কায় শিশু নিহত
গারো পাহাড়ের পানি হাতায় ঘুরতে এসে ভোগা নদীতে ডুবে ২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু